আলহামদুলিল্লাহ্ী ওয়াহদা ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আ’লা মাল্লা নাবিয়্যা বা’য়দা
ইসলাম ধর্মে দল তৈরী করা বা গ্রুপিং করা নিষেধ। যে কোন ভিত্তিতেই ইসলামে দল তৈরী করে বিভক্ত হওয়া নিষেধ। পবিত্র কুরআন এ আল্লাহ সরাসরি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমরা বিভক্ত না হই।
“আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা- আল ইমরান, আয়াত সংখ্যা- ১০৩)
মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত শিয়া, সুন্নী, হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী, সালাফী, আহলে হাদীস, জামায়াতে ইসলাম, মোহাম্মেদীয়া, আহম্মেদীয়া, আহলে সুন্নাহ, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত সহ আরও অনেক দল বের হয়েছে। এদের কেউ কেউ আবার বলছেন- হানাফী, সালাফী, আহলে হাদীস, শাফেয়ী, সুন্নী বলে পরিচয় দেয়া ফরজ, ওয়াজিব। এদের একদল অন্য দল থেকে বিচ্ছিন্ন। দল সৃষ্টি করলে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবেই। কিন্তু আল্লাহ আমাদের বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ আরও বলেছেন- রাসূল(সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে-
“নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপার আল্লাহ তা`আয়ালার নিকট সমর্পিত। অতঃপর তিনি(আল্লাহ) বলে দেবেন যা কিছু তারা করে থাকে।” (সূরা-আন’আম, আয়াত সংখ্যা-১৫৯)
ভাল করে আর একবার আয়াত পড়ুন। এই আয়াতের প্রেক্ষিতে শুধু একটা প্রশ্ন মুসলিম ভাইদের কেছে। যার সাথে রাসূল(সা) কোনো সম্পর্ক নেই সে কি মুসলিম? সে কি কখনো জান্নাতে যেতে পারবে?? কি উত্তর দিবেন আপনারা???
আল্লাহ সূরা রূম এর ৩১ ও ৩২ নং আয়াতে আরও বলেছেন-
“সবাই তাঁর অভিমুখী হও এবং ভয় কর, নামায কায়েম কর এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত।”
একটা বার চিন্তা করেন, এখানে অনেকটা মুশরিকদের সাথে তুলনা করা হয়েছে যারা ধর্মে মতভেদ সৃষ্টি করে এবং নিজের মত নিয়ে উল্লাস করে। এরপরও কি কেউ বলতে পারবেন দল সৃষ্টি করে বিভক্ত হওয়া উচিত? এরপরও কি কেউ দল সৃষ্টি করবেন???
রাসূল(সাঃ) বলেছেন- যদি কেউ মুসলিম উম্মাহর একতা নষ্ট করতে চায় তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত কর সে যেই হোক না কেন। যদি তাতে না থামে তাহলে মেরে ফেল (সহিহ মুসলিম, ৪৫৬৫ নং হাদীস)
রাসূল(সাঃ) এর এমন কঠোর কথার পর কেউ কি দল তৈরী করবেন ???
মুহাম্মদ(সাঃ) এবং তার বংশধরদের খিলাফত সংক্রান্ত ঘটনায় শিয়া তৈরী হয়। যখন শিয়া তৈরী হল, তখন তাদের থেকে আলাদা হবার জন্য সুন্নী তৈরী হল এবং তারা আবু বকর(রাঃ) কে প্রথম খলিফা হিসেবে মানত যা শিয়ারা মানত না। সেই শিয়া সুন্নী আজ কত ভাগে বিভক্ত? এরা সবাই ইসলামকে খন্ড বিখন্ড করেছে। নিজের একটা মতবাদ নিয়ে একটা আলাদা নামে দল তৈরী করা, অন্য মুসলিম ভাইদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া এগুলো ইসলাম সমর্থন করে না।
আমাদের কি করা উচিত? কি বলে নিজেকে পরিচয় দিবেন?? নিজেকে কোন দলে ফেলবেন??? কি আকড়ে ধরে থাকবেন?? আমাদের জানতে হবে রাসূল(সাঃ) কোন দলের ছিলেন?? তিনি কি শিয়া সুন্নী ছিলেন? তিনি কি হানাফী ছিলেন নাকি সালাফী?
আমাদের রাসূল(সাঃ) ছিলেন মুসলিম। এবং আমাদের এইটা শক্ত করে আকড়ে ধরতে হবে। আল্লাহ পবিত্র কুরআন এ আমাদের মুসলিম বলেছেন। এই কুরআন এর আগেও বিশ্বাসীদের মুসলিম বলা হত।
আল্লাহ পবিত্র কুরআন এ বলেছেন-
তোমরা আল্লাহর জন্যে শ্রম স্বীকার কর যেভাবে শ্রম স্বীকার করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে পছন্দ করেছেন এবং ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেননি। তোমরা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের ধর্মে কায়েম থাক। তিনিই তোমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন পূর্বেও এবং এই কোরআনেও, যাতে রসূল তোমাদের জন্যে সাক্ষ্যদাতা এবং তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলির জন্যে। সুতরাং তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে শক্তভাবে ধারণ কর। তিনিই তোমাদের মালিক। অতএব তিনি কত উত্তম মালিক এবং কত উত্তম সাহায্যকারী।(সূরাঃ হাজ্জ, আয়াত-নম্বরঃ ৭৮)
তাহলে আল্লাহর দেয়া নাম আকড়ে না ধরে নিজেকে শিয়া বা সুন্নী বলার কি দরকার? কি দরকার বলা যে আমরা হানাফী, আমরা শাফেয়ী। কি দরকার সালাফী বলে পরিচয় দেয়া। আল্লাহর দেয়া নামের চেয়ে সুন্দর নাম কি আর কেউ দিতে পারবেন?
সবাই জানে, আমলের কিছুটা পার্থক্য থাকবে। এই পার্থক্য থাকার পরও নতুন দল তৈরী না করে আমাদের একসাথে থাকা উচিত। যারা নিজেদের হানাফী বলে পরিচয় দেয়, তারা মনে করে শাফেয়ী যেভাবে ইবাদত করে এটা ভুল। আর শাফেয়ী মনে করে হানাফীরা ভুল পথে আছে। এখানে আমি বলেছি পরিচয় দেয় মানে সাধারণ মুসলিম, আলেমদের বলি নাই। তারা একে অন্য থেকে বিভক্ত। কেন এই বিভক্তি? সামান্য একটু আমলের পার্থক্য হলে দল তৈরী করবেন? পার্থক্য থাকার পরও নিজের মুসলিম পরিচয় আকড়ে ধরা উচিত।
এখানে কিছু মানুষ যুক্তি দেখায়- তারা বলে, মুসলিম তো সবাই। কিন্তু কোন ধরণের মুসলিম এটা বুঝাতে আমরা অন্য নামে ডাকি।
ভাই মুসলিমের আবার রকম কিসের? সব মুসলিম এক। মুসলিম সেই ব্যক্তি, যে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর কাছে সমর্পিত করে শান্তি অর্জন করে। প্রত্যেক মুসলিমের উচিত কুরআন মেনে চলা।
কুরআন এ বলা হয়েছে- আল্লাহকে মানো ও তার রাসূলকে মানো (সূরা নিসা- ৫৯)
তাই রাসূল(সাঃ) কে আমাদের মানতে হবে, যেহেতু তিনি আল্লাহর রাসূল ছিলেন। রাসূল(সাঃ) এর নির্দেশ পাবেন হাদীসে (সহিহ হাদীস)। এবং যে কুরআন ও সহিহ হাদীসকে আকড়ে ধরে থাকবে সেই মুসলিম হিসেবে গন্য হবে।
চার ইমাম(রঃ) বা অন্যান্য যারা ইসলামিক স্কলার তারা সবাই ইসলামের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আল্লাহ তাদের অশেষ রহমত দিয়েছেন এবং আল্লাহ তাদের জান্নাত দান করুন(আমিন)। ইসলামে তাদের অবদান অসীম। আমরা তাদের ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। তারা ইসলামকে বিভক্ত করেন নি। কিন্তু তাদের নামে যারা দল করে ইসলামকে বিভক্তির পথ অবলম্বন করেছেন আমি তাদের শুধুমাত্র এই দল তৈরীর কথাটা মানতে পারছি না। কারণ কুরআন এ নিষিদ্ধ কোন জিনিস মানা কোন মুসলিম এর পক্ষে সম্ভব না।
বিভক্ত হবার অন্যতম কারণ হল ধর্মীয় ফতোয়া নিয়ে মতভেদ। আসুন তাহলে সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতটা আবার দেখি- হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।
তাহলে যদি কোন বিষয় নিয়ে মতভেদ হয়, বিবাদের সম্ভাবনা হয় তাহলে দেখতে হবে আল্লাহ কি নির্দেশ দিয়েছেন, রাসূল(সাঃ) এই ব্যাপারে কি বলেছেন। ঐটাই আমাদের মানা উচিত। তাহলেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিবাদ মিটে যায়। আর এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।
সবশেষে একটা কুরআন এর আয়াত ও একটা হাদীস দিতে চাই-
আল্লাহ কুরআন এ বলেছেন- তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম? (সূরা ফুসিলাত, আয়াত-৩৩)
এই জন্য মুসলিম এর চেয়ে ভাল কিছু আমার জানা নাই। আমাদের সবারই নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়া উচিত।
আর একটা হাদীস আপনাদের বলব- এটা পাবেন সহীহ বুখারী ৩৬০৬ নং হাদীস এ।
হুযাইফাহ ইবন ইয়ামান (রাঃ) বলেন, লোকজন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন আর আমি তাঁকে অকল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম; এই ভয়ে যেন আমি ঐ সবের মধ্যে পড়ে না যাই।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা জাহিলীয়্যাতে অকল্যাণকর অবস্থায় জীবন যাপন করতাম অতঃপর আল্লাহ্ আমাদের এ কল্যাণ দান করেছেন। এ কল্যাণকর অবস্থার পর আবার কোন অকল্যাণের আশঙ্কা আছে কি?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঐ অকল্যাণের পর কোন কল্যাণ আছে কি?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, আছে। তবে তাতে কিছু মন্দ থাকবে।
আমি বললাম, সে মন্দটা কি?
তিনি বললেন, এমন একদল লোক যারা মানুষকে ঐ দিকে নিয়ে যাবে যা আমার সুন্নত না। তাদের কাজে ভাল-মন্দ সবই থাকবে।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, অতঃপর কি আরো অকল্যাণ আছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, কিছু মানুষ জাহান্নামের দরজার দিকে আমন্ত্রণ জানাবে। যারা তাদের ডাকে সাড়া দিবে তাকেই তারা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
আমি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এদের পরিচয় বর্ণনা করুন।
তিনি বললেন, তারা আমাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত এবং কথা বলবে আমাদেরই ভাষায়।
আমি বললাম, আমি যদি এ অবস্থায় পড়ে যাই তাহলে আপনি আমাকে কি করতে আদেশ দেন?
তিনি বললেন, মুসলিমদের দল ও তাঁদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে।
আমি বললাম, যদি মুসলিমদের এহেন দল ও ইমাম না থাকে?
তিনি বলেন, তখন তুমি তাদের সকল দল উপদলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে এবং আল্লাহর সান্নিধ্যে না আসা পর্যন্ত বৃক্ষমূল দাঁতে আঁকড়ে ধরে হলেও তোমার দীনের উপর থাকবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বুঝান তৌফীক দান করুন।
আমিন !